ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি দেশে আসার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানিয়েছে মঙ্গলবার এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা আসেনি। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এ বিষয়ে কথা বললেও মন্ত্রিসভা থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে অপসারণের বিষয়ে স্পষ্ট কোন তথ্য জানাতে পারেননি। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দলীয় এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকীকে ‘মুখফোঁড়’ আখ্যা দিয়ে তার কথা কানে না নেয়ার জন্য দলের নেতাকর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের অন্য এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে দলীয় সভানেত্রী দেশে ফেরার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণের বিষয়ে দলের কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি না হলেও উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসবে সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। আমরা জানি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি তা-ই করেছেন। এদিকে লতিফ সিদ্দিকীকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন সংবাদপত্র সংবাদ প্রচার করে। তবে কোথাও সুনির্দিষ্ট করে খবরের সূত্র উল্লেখ করা হয়নি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা মানবজমিনকে বলেন, লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। নির্দেশনা পাওয়া গেলে আপনারা জানতে পারবেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, পবিত্র হজ নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেয়ায় দলীয় পদও হারাচ্ছেন লতিফ সিদ্দিকী। দলের প্রেসিডিয়ামের পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
হজ, তাবলীগ, টকশো ও প্রধানমন্ত্রী পুত্রকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেয়ায় আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে সারা দেশ। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম হজ নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেয়ায় সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ইতিমধ্যে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
রোববার নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি হজ ও তাবলীগের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীর যত বিরোধী তার থেকেও হজ ও তাবলীগের বিরোধী। এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছে। এদের কোন কাম নেই। এরা কোন প্রডাকশন দিচ্ছে না। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে। ওই অনুষ্ঠানে টক শো আলোচকদেরও গালিগালাজ করেন তিনি।
তার এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় হেফাজতে ইসলাম ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে লাগাতার কর্মসূচির মাধ্যমে দেশ অচল করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন তারা। হেফাজতের পক্ষ থেকে গতকাল দুই দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এবং শুক্রবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে। লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন আজ বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। একই কর্মসূচি দিয়েছে আরও কয়েকটি ইসলামী দল ও সংগঠন।
প্রধানমন্ত্রী ফিরলে ব্যবস্থা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার দুপুরে সাভারে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের বড় দায়িত্বে থেকে সরকারেরই ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর বক্তব্য দেয়া বা আচরণ করা কারও জন্য সমীচীন নয়।
তিনি বলেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আছে, তিনি দেশে ফিরলে এ ব্যাপারে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জয়কে নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তা-ও ঠিক নয়।
বঙ্গবন্ধু কন্যা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন: আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসবে সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। আমরা জানি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি তাই করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় গুলশান-বনানী পূজামণ্ডপ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের একথা বলেন তিনি। সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, লতিফ সিদ্দিকী যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন তা ন্যক্কারজনক। এটি শুধু ইসলাম ধর্মের জন্য অবমাননাকর নয়, সব ধর্মের জন্য একই ভাবে প্রযোজ্য। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা দেশের বাইরে থেকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যা নজিরবিহীন। এর আগে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি।
এদিকে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়েছে এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে যুবলীগ। গতকাল যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. হারুনুর রশিদ বিবৃতির মাধ্যমে এ অভিনন্দন জানান। সংগঠনটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। একই সঙ্গে তারা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হজ। তা নিয়ে লতিফ সিদ্দিকী যে জঘন্য ও কুৎসিত মন্তব্য করেছেন, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। তার এ বক্তব্যে মনে হয় যে, তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। একই সঙ্গে তার এ বক্তব্যে নতুন কোন ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা এ নিয়ে নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী ফিরলে লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে- ওবায়দুল কাদের
স্টাফ রিপোর্টার, সাভার থেকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের সিটি সেন্টারের সামনে দ্বিতীয় ফুট ওভারব্রিজ উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের বড় দায়িত্বে থেকে সরকারেরই ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর বক্তব্য দেয়া বা আচরণ করা কারও জন্য সমীচীন নয়।
গত রোববার নিউ ইয়র্কে স্থানীয় টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, আমি কিন্তু হজ আর তাবলীগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর ওই বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ওই ভিডিওতে তাকে বলতে দেখা যায়, ‘এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার (জনশক্তি) নষ্ট হয়। এই হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছেন। এদের কোন কাজ নেই। কোন প্রডাকশন নেই। শুধু ডিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা বিদেশে দিয়ে আসছে।’ লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যের সমালোচনায় ওবায়দুল কাদের বলেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আছে, তিনি দেশে ফিরলে এ ব্যাপারে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘ভবিষ্যৎ নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাদের বলেন, জয়কে নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তা-ও ঠিক নয়। নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভূমিকা নিয়ে মন্ত্রীর মন্তব্য চাইলে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন। ‘জয় ভাই’ কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নন। তিনি কোন সিদ্ধান্ত নেয়ারও কেউ নন। এর আগে মন্ত্রী ফিতা কেটে ফুটওভার ব্রিজের উদ্বোধন শেষে উপরে ওঠার সময় নেতাকর্মীদের ধাক্কাধাকিতে উঠতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ সময় ওভারব্রিজে টাঙানো বড় বড় ব্যানারে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান ও তার নিজের ছবির দিকে চোখ যায় মন্ত্রীর। তাকে স্বাগত জানিয়েই ছিন্নমূল হকার্স লীগ ও আওয়ামী হকার্স লীগ ব্রিজের দুই পাশে বিশাল আকৃতির এসব ব্যানার টাঙায়। ক্ষুব্ধ স্বরে কাদের বলেন, কার নির্দেশে এসব ব্যানারে আমার ছবি দেয়া হয়েছে। যারা আমার ছবি ব্যবহার করেছেন, তারা ঠিক করেননি। নেতারা নিজেদের ছবি দিয়ে যা-ই করুক, আমার ছবি জুড়ে দিতে পারেন না। তাৎক্ষণিকভাবে এ সব ব্যানার খুলে ফেলার নির্দেশ দেন মন্ত্রী, পরে ব্যানার খুলে ফেলা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান মোল্যা, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। (১লা অক্টোবর, দৈনিক মানবজমিন)