নিউইয়র্ক থেকে : রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় পতাকা আচ্ছাদিত কফিনে মুক্তিযোদ্ধা, মানবাধিকার নেতা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, ইউএসএ এর সভাপতি, চিরকুমার রতুন বড়ুয়াকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে গভীর শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় জানানো হয়েছে নিউইয়র্কে।
সহস্রাধিক প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে তার সেবাকর্মের স্বীকৃতির তিলক দেওয়া হয় কপাল। রতন বড়ুয়ার কফিনে প্রবাসের সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। তিনদিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির শেষদিনে রোববার বিকেলে মানবাধিকার নেতা রতন বড়ুয়ার প্রতি শেষশ্রদ্ধা জানাতে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রথমে রতন বড়ুয়ার কফিনে বাংলাদেশের জাতীয় পাতা জড়িয়ে দেন ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, আকরামুল কাদের ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে এম মোমেন। এরপর স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের দুই শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় ও শহীদ হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। এ সময় রতন বড়ুয়ার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি রতন বড়ুয়ার কফিনে বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশ মিশনের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে রতন বড়ুয়াকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় পুষ্পস্তবক অর্পণের পর।
ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের ও জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত এ কে এম মোমেনসহ প্রবাসের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতাসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধা, কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সংগঠক তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের রতন বড়ুয়ার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, সবার প্রিয় ও পরিচিত রতন বড়ুয়া আজীবন দৈন্য মানসিকতার বিরুদ্ধে শান্তির জন্য ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার মরদেহ গবেষণার কাজে লাগানোর জন্য ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে দান করে গেছেন। তার কর্মই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
রাষ্ট্রদূত ড. এ কে এ মোমেন রতন বড়ুয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, রতন বড়ুয়া সব সময়ই মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। দল-মত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে মানবসেবী হিসেবে সবার মনে স্থান করে নিয়েছেন। তার মৃত্যুতে সমাজ একজন মানবাধিকার নেতাকে হারালো।
বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত প্রেসমিনিস্টার স্বপন সাহা দূতাবাসের পক্ষ থেকে রতন বড়ুয়ার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুদিন আগেই নিউইয়র্কে পৌঁছান। নিজের গ্রিনকার্ড করতে না পারলেও অনেক মানুষের গ্রিনকার্ড প্রাপ্তিতে রতন বড়ুয়ার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আর গ্রিনকার্ড না থাকায় তিনি দেশেও ফিরতে পারেননি।
মানুষের প্রয়োজনে তিনি একাধিকবার ডিটেনশন সেন্টার পরিদর্শন করেন এবং সেখানে আটক অনেকের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। রতন বড়ুয়ার জীবনের শেষ স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা। এ জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছিলেন।
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান, একুশে পদকপ্রাপ্ত জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, একুশে পদকপ্রাপ্ত জনপ্রিয় নাট্যাভিনেতা জামাল উদ্দিন হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে কমান্ডার নূরুন্নবী, গোলাম মোস্তফা, আব্দুল মুকিত চৌধুরী, ডা. মাসুদল হাসান, ও মোহাম্মদ মনির হোসেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক নিনি ওয়াহিদ, বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার কবীর আনোয়ার, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সভাপতি আকতার হোসেন, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এটিএন বাংলা ইউএসএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফখরুল আলম, কলামিষ্ট সুব্রত বড়ুয়া, যুক্তরাষ্ট্র যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক রেজাউল করীম চৌধুরী, রাজনীতিক জাকারিয়া চৌধুরী প্রমুখ শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মিডল মাদারশা গ্রামের সন্তান রতন বড়ুয়ার বাবার নাম অমিয় কান্তি বড়ুয়া (প্রয়াত)। ১৯৮৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেসে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সম্মেলনে বাংলাদেশের যুব সমাজের প্রতিনিধি হিসেব যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র আসেন।
প্রয়াত রতন বড়ুয়ার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে গত বছর (২০১৩ সাল) সেপ্টেম্বর মাসে। সে ময় চিকিৎসকরা জানান, রতন বড়ুয়ার ৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত বাঁচবেন। তবে মরণব্যাধির কথা জেনেও রতন বড়ুয়া তার মানব সেবা থেকে পিছপা হননি। প্রয়াত রতন বড়ুয়ার সহোদর নয়ন বড়ুয়া জানান, রতন বড়ুয়ার মরদেহ সোমবার অথবা মঙ্গলবার (নিউইয়র্ক সময় রাতে) জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় পাঠানো হবে এবং পৌঁছবে ১০ এপ্রিল বুধবার অথবা ১১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার।
ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে রতন বড়ুয়ার মরদেহ গ্রহণ করার পর ঢাকার বৌদ্ধ মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানোর পাশাপাশি ঢাকাবাসী শেষশ্রদ্ধা জানাবেন। রতন বড়ুয়াকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৌদ্ধমন্দিরের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নিজে সময় না পেলে তার পক্ষ থেকে রতন বড়ুয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। বৌদ্ধ মন্দিরের আনুষ্ঠানিকতার পর হেলিকপ্টারে করে রতন বড়ুয়ার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মিডল মাদারশা গ্রামে।ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রতন বড়ুয়া (৬৬) গত ৩১ মার্চ সোমবার সকাল ৬টার দিকে (নিউইয়র্ক সময়) কুইন্সের জ্যামাইকা হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মানবসেবায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য প্রয়াত রতন বড়ুয়া ইউনাইটেড ফর হিউম্যান রাইটের ‘পিস অ্যান্ড টলারেন্স-২০০৯ অ্যাওয়ার্ড’, এবিআই ইউএসএ’র ‘একমপ্লিস লিডার, ইউনাইটেড কালচারাল কনভেনশনের ‘ইন্টারন্যাশনাল পিস প্রাইজ-২০০৭’, ‘গোল্ড মেডেল অব দ্য টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি’, আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টটিউটের ‘ডিগনিটি অব অনার্স’, ইন্টার রিলিজিয়াস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিসের ‘অ্যাম্বাসেডর ফর পিস অ্যাওয়ার্ড’ প্রভৃতি সম্মাননা লাভ করেন।
চার্চে আনুষ্ঠানিকতায় রতন বড়ুয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (বাকসু)-এর সাবেক জিএস ড. প্রদীপ রঞ্জন কর। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সাংবাদিক মুজাহিদ আনসারী।
নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতিতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, ব্যক্তিজীবনে রতন বড়ুয়া ছিলেন একজন সৎ, পরোপকারী, সাদামনের মানুষ। আমৃত্যু তিনি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তার মৃত্যুতে কমিউনিটি সত্যিকারের একজন মানবপ্রেমী মানুষকে হারালো।
এদিকে, বাংলাদেশ সোসাইটি ইন নিউইয়র্ক প্রয়াত রতন বড়ুয়ার মরদেহ বাংলাদেশে পাঠাতে এক হাজার ডলার দিয়েছে। (সৌজন্যে বাপ্স নিউজ )