জীবনের শেষ সন্ধ্যায় গণভবন থেকে ফেরার পথে ‘কালো গাড়ি’ দেখে অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘এটা একটা আশ্চর্য্য বিষয়! ঐদিন যে গাড়িটি তাঁকে নিতে আসে সেটি কালো রঙের ছিল। কালো রঙের গাড়িটি দেখে বঙ্গবন্ধু খুব মন খারাপ করেন। তিনি জানান, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার স্বার্থে বঙ্গবন্ধু কোন্ দিন কোন্ গাড়িতে চড়বেন, সেটা তাঁর প্রটোকলের লোকরাই ঠিক করতো। তিনটি গাড়িতে যাতায়াত করতেন তিনি। তার মধ্যে একটি সাদা ও একটি কালো। বঙ্গবন্ধু যখন গণভবন থেকে চলে যান তখন আমরা কয়েকজন প্রতিদিনের মতোই তাঁকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়েছিলাম। সেদিন গণভবন থেকে ঘরে ফেরার মুহূর্তে অন্যদিনের মতোই সচিবদের কাছ থেকে বিদায় নিলেও নিভৃতে এক বিষন্নতার সুরই যেন বেজে উঠেছিল সবার হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন আপোষহীন ও অবিচল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও থমকে গিয়েছিলেন শেষ বারের মতো গাড়িতে উঠতে গিয়ে! বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘তিনি জানতেন না, আরেকটি সন্ধ্যা তাঁর জীবনে আসবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে?’ জীবনের শেষ দিনটি কি ধরনের কর্মকান্ডে ব্যাস্ত ছিলেন এই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফরাসউদ্দিন জানান, জাতির জনকের জীবনের শেষ বিকেলটা অন্যান্য দিনের মতো রুটিন কাজ চললেও দু’টি বিশেষ প্রস্তুতি চলছিল সেদিন গণভবনে। এক. পরেরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি। দুই. রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, যুগ্ম সচিব এম মনোয়ারুল ইসলাম এবং রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব শহীদ কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমদ-এর বিদায় সংবর্ধ্বনা। সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু গণভবন থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে তাঁর একান্ত সচিব, যুগ্ম সচিব এবং সামরিক সচিবের বিদায় সম্পর্কে ও বঙ্গবন্ধু খানিকটা বিষন্ন ছিলেন বলে জানান ফরাস উদ্দিন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মনোয়ার আর ফরাস দু’দিন পরেই চলে যাবে; ছেলে দুটো মায়া লাগিয়ে যাচ্ছে। খারাপ লাগবে খুবই। ভাগ্যিস জামিল এখানেই থাকছে।’ উল্লেখ্য, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, এম মনোয়ারুল ইসলাম অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রী লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার অনুমতি নিয়ে ১৭ আগস্ট চলে যাওয়ার কথা ছিল। আর শহীদ কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে ডাইরেক্টর ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিএফআই, বর্তমানে ডিজিএফআই) পদে যোগ দেয়ার কথা ছিল। ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, সন্ধাবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো: আবদুল মতিন চৌধুরীর সাথে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি, বক্তৃতার বিষয়বস্তু আলোচনার পাশাপাশি খাবার নিয়েও কথা হয়। যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বহিষ্কৃৃত হয়েছিলেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তাঁকে ‘সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রী দিতে যাচ্ছে, সেটি কতটা সুখকর হবে, সেটি নিয়েও বঙ্গবন্ধুর মনে সংশয় কাজ করেছিল। রাষ্ট্রপতির বিদায়ী একান্ত সচিব হিসেবে ফরাসউদ্দিন সেদিন বেশির ভাগ সময় বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছিই ছিলেন। তিনি জানান, প্রতিদিন কাজ শেষে গণভবনের সামনের লনে একাকী পায়চারি, গাছেদের সাথে কথা বলা, লেকের পানিতে মাছেদের সাথে খেলা করা সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর নিয়মিত অভ্যাস। তবে সেদিন সন্ধ্যায় গণভবনের বাইরে দলবল নিয়ে মুক্ত আলোচনার নিত্যকার আসর বসেনি। ঐদিন দুপুরে নোয়াখালীতে ভারতীয় একটি হেলিকপ্টার ভূপতিত হওয়ার ঘটনায় অন্যান্যরা ব্যস্ত ছিলেন। |
||||||||
|